News

কোভিড সময়ে অব্যক্ত অন্তরালের নায়করা

বিশ্বব্যপী অনিবার্য মহামারী বাংলাদেশ সরকারকে বাধ্য করেছিল ২৬ শে মার্চ, ২০২০ থেকে লকডাউন ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করতে। সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের নিজস্ব কার্যক্রমও বন্ধ রাখতে হয়েছিল। নতুন রোগের আবির্ভাবে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ছিল। চিকিৎসক ও নার্সরা এই রোগে আক্রান্ত শত শত মানুষদের নিরাময়ে রাতদিন পরিশ্রম করেছেন। লকডাউন ও সাধারণ ছুটি চলাকালীন অধিকাংশ মানুষ বাড়িতে থেকে কাজ (ওয়ার্ক ফ্রম হোম) করছিলেন। তবে কিছু নিবেদিত মানুষ তাদের কর্মস্থল ‘বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে’ উপস্থিত থেকে কাজ করে যাচ্ছিলেন। তারা সরকারকে ডিজিটালভাবে চলমান রাখতে শিফট -এ কাজ করছিলেন। তাদের তত্ত¡াবধানে জাতীয় ডাটা সেন্টার সচল রাখা হয়েছিল, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সভাসমূহ পরিচালিত হয়েছিল এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোসমুহে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছিল। তারাই ডিজিটাল বাংলাদেশের সৈনিক।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের একটি সংস্থা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল কতৃক নির্মিত পরিকাঠামোসমূহ এসময় দেশ ও জাতির অনুক‚লে সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়। এসকল অপরিহার্য ও বিস্ময়কর সেবাদানের পিছনের মানুষরা প্রচারবিমুখ হন। সরকারের পরিষেবাসমূহ চলমান রাখতে লোকচক্ষুর অন্তরালে তারা দিনরাত কাজ করে যান। অনেকসময় একনাগাড়ে ২৪ ঘন্টার বেশিও কাজ করতে হয় তাদের। ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতি অটল সংকল্পই তাদের অনুপ্রাণিত করে। তাদের মধ্যে কেউ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছিল, কাউকে হাসপাতালে আইসিইউতে থাকতেও হয়েছিল। কিন্তু সুস্থ হওয়ার সাথে সাথেই তারা পুনরায় দায়িত্বপালন শুরু করেন। এরুপ সাহসী সৈনিকদেরই একজন ডাটা সেন্টারে দায়িত্ব পালনকালে কোভিড আক্রান্ত হয়। তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীও সংক্রমিত হন। পরে তাদের সন্তান রক্তের সংক্রামণসহ সময়ের আগেই জন্ম নেয়, তিন মাসেরও বেশি সময় নবজাতককে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে থাকতে হয়েছিল এবং চিকিৎসার জন্য অতিরিক্ত রক্ত সরবরাহ করতে হয়েছিল। শিশুকে হাসপাতালের বিছানায় শুইয়ে রেখে এই পিতা জরুরী পরিস্থিতিতে কর্মস্থলে সেবা প্রদানে সচেষ্ট ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, তার শিশু হাসপাতাল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরের দিনই তিনি হাসিমুখে কর্মস্থলে উপস্থিত হয়ে পুনরায় দায়িত্ব পালন শুরু করেছিলেন। আসুন আমরা পর্দার আড়ালের এই অতন্দ্র মহৎপ্রাণদের অভিবাদন জানাই যারা মহামারী এবং লকডাউনের সময় একান্তভাবে দায়িত্বপালনের মধ্য দিয়ে জাতিকে সচল রাখার জন্য ব্যাকএন্ডে কাজ করে যান।

ব্যাংক ও গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোসমূহে সাইবার আক্রমণের ঘটনা বাড়ছিল। সাইবার প্রতিরক্ষা কর্মীগণ রাষ্ট্রের সাইবার স্পেসে হুমকিস্বরূপ সম্ভাব্য দুর্বলতা চিহ্নিত করতে তৎপর ছিলেন। ২০২০ সালটি ছিল শুভ উদযাপনের বছর। এটি ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। সাইবার ডিফেন্ডার টিম পেশাদারদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সাইবার সিকিউরিটিতে ক্যারিয়ারের প্রস্তুতি শিক্ষার্থীদের পরিচিত করতে সাইবার ড্রিলের আয়োজন করে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রোগ্রামের অংশ হিসাবে সংঘটিত জাতীয় সাইবার ড্রিলটি আরও স্মরণীয় ছিল। দু’দিনের ইভেন্টে ১০৩৫ জন অংশগ্রহণকারী সহ মোট ২২০ টি দল অংশ নিয়েছিল।

সাইবার প্রতিরক্ষা টিম হ্যাকারদের দ্বারা ব্যবহৃত হওয়া ৯০২টি দুর্বলতা নিরসন করতে ৩২টি প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করেছে। তারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাইবার হুমকির বিষয়ে ১৪০টি ‘থ্রেট ইন্টেলিজেন্স’ সরবরাহ এবং হ্যাকারদের বিরুদ্ধে সাইবার সিকিউরিটি অবস্থান দৃঢ়তর করতে সহায়তা করেছিল। এসব কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংকে হ্যাকিং ও অর্থ অপসারণের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি থেকে দেশকে রক্ষা করেছে। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের ডাটা সেন্টার এবং কমপিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিমের (সিআইআরটি) সাইবার ডিফেন্স টিম সম্পূর্ণ সিংক্রোনাইজেশনে কাজ করেছে। কোভিড ১৯ ভ্যাকসিনেশন অ্যাপ্লিকেশন কতৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এটিকে বিদেশে আমাজন ক্লাউডে হোস্ট করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের পক্ষ হতে ডাটা সেন্টার ক্লাউডে স্থানীয়ভাবে এটি হোস্ট করার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব দেয়া হয়। কতৃপক্ষ স্থানীয়ভাবে ডাটা সেন্টারের ক্লাউডে হোস্ট করতে সম্মত হয়। প্রাথমিক কিছু চ্যালেঞ্জের পর সিস্টেমটি এখনও পর্যন্ত ভালভাবে কাজ করেছে এবং সরকারি তহবিলের প্রায় নব্বই কোটি টাকা সাশ্রয় করেছে।

বিসিসি এবং সার্ট দেশে তৈরি অ্যাপসমুহ উদ্বোধন করার জন্য তাদের প্রচেষ্টা একত্রিত করেছে। এর ফলে সরকারের নিজস্ব অনলাইন ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম, সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর জন্য অনলাইন নিয়োগ ব্যবস্থা সফলভাবে প্রস্তুত ও চালু হয়েছে।এই টিম বৈশ্বিক সাইবার ‘থ্রেট ইন্টেলিজেন্স’ তথ্য সংগ্রহ করে রাষ্ট্রের জাতীয় সাইবার নিরাপত্তার জন্য অভিযোগ্য গোয়েন্দা তথ্যে (অ্যাকশনেবল ইন্টেলিজেন্স) রূপান্তর করতে নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার তৈরি করেছে। এই সতর্কতা অনেক প্রতিষ্ঠানকে হ্যাকারদের কাছে সংবেদনশীল তথ্য হারানোর অবমাননা থেকে বাঁচিয়েছে ।

আমাদের জাতি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ -এর যাত্রায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। ডেটা সেন্টার এবং সাইবার ডিফেন্স দল কঠোর পরিশ্রম করেছে এবং সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো উন্নয়ন করতে সরাসরি অবদান রেখেছে। এই অবদানগুলো দেশকে আইটিইউ সাইবার সিকিউরিটি সূচকে ২৫ স্থান অগ্রসর হতে সহায়তা করেছে এবং ৭৮তম অবস্থান থেকে ৫৩তম অবস্থান অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এটি শুধু সূচকে উন্নতি নয়। এই উন্নতি দেশের জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সরাসরি সহায়ক।

ডেটা সেন্টার এবং সাইবার ডিফেন্সের নবীণ দলটি জাতির কাছে সুরক্ষিত ও নির্বিঘ্ন ডিজিটাল পরিষেবা সরবরাহ করতে নিরলসভাবে কাজ করেছে। এসবই ডিজিটাল বাংলাদেশের সত্যিকার অর্জন। এটি শুধু আরেকটি স্লোগান নয় বরং একটি দর্শন বা নীতিতে পরিণত হয়েছে। এই দর্শন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম সাদরে গ্রহণ করেছে। এই প্রতিভাবান এবং অনমনীয় মানুষদের কয়েককজনের নেতৃত্ব দেওয়া আমার পরম সৌভাগ্য। অন্যান্য বিভাগ, জরুরী পরিষেবা, মিডিয়া ইত্যাদিতে আরও অনেক অন্তরালের নায়ক রয়েছেন যাদের কাজ জনসম্মুখে আসে না। আসুন মহামারীকালীন সময়ে এই সমস্ত মহান পুরুষ ও নারীদেরকে আমাদের দেশকে এগিয়ে নেয়া এবং যত্নে লালিত ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়নে তাদের ত্যাগের জন্য অভিবাদন জানাই।

Leave a Reply